শিশু ধর্ষণ বলাৎকার হত্যা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে হবে

শিশু ধর্ষণ বলাৎকার হত্যা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়াতে হবে

আমিরুজ্জামান ফারুক:

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাব ধরে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পথ চলছি। জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষতার হাত ধরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্য উন্নত জীবনমানের পরিবেশ ও পরিবর্তশীল সামাজিকতার মধ্যেও অনগ্রসরতা পশ্চাৎপদতায় বিচার বিবেকবোধহীনতার ইত্যাকার ঘটনা সমূহের প্রকাশ আমাদের সমাজ সভ্যতার   অগ্রগতির স্মারক চিহ্নকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টতায় এর প্রকাশ প্রচারে ভূমিকা রাখতে গিয়ে আমরাও বিস্মিত, বিব্রত। পাঠক নিশ্চয় সুখকর মনে করেন না। তবে প্রশ্ন ওঠে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে। কতকাল যাবৎ আমরা প্রতিবাদহীন নিস্পৃহ নিরুদ্বেগ ‘ভালমানুষ’ হয়ে থকব, না কি আমাদেরও আছে কিছু করণীয়। কথাগুলো বলছি সদ্য বিগত কয়েকটি দুঃখজনক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রেক্ষাপটে।

পাক্ষিক মুকসুদপুর সংবাদের ১৬ ফেব্রয়ারি সংখ্যার শিরোনাম ‘বাঁশবাড়ীয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণ ধর্ষক ইসমাইলসহ ৫ কারাগারে’। প্রকাশ: পরিজান বেগম মহিলা কওমী মাদ্রাসার ২য় শ্রেণির ১০ বৎসরের শিক্ষার্থীকে মাদ্রাসার মোহতামিম মাওলানা ইসমাইল সন্ধ্যায় তার কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ধামাধাপা দিয়ে ধর্ষককে বাঁচাতে তৎপর অন্য পাঁচ শিক্ষকসহ ধর্ষক ইসমাইলকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছে।

এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার শিরোনাম ‘ভাবড়াশুরে শিশু ধর্ষণের পর হত্যা মূল হোতা ক্ষ্ণৃ বর গ্রেফতার’। প্রকাশ: ভাবড়াশুরে ১৮ বৎসরের যুবক কৃষ্ণ বর তার ৯ বৎসর বয়সী আপন মামাত বোন নন্দীকে উপুর্যপরি ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করে। কৃষ্ণ মাদকাসক্ত থাকায় নন্দীকেও ফেমিকন ট্যাবলেট, মাউন্টেইন এনার্জিড্রিঙ্ক ইত্যাদি খাইয়ে অচেতন করে ধর্ষণের পর হত্যা করে।

আরো একটু আগে ১৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় শিরোনাম ‘মাদ্রাসা ছাত্রকে বলাৎকার নাদেরকে পুলিশে দিল জনতা’। প্রকাশ: বহুগ্রাম ইউনিয়নের গাড়লগাতী গ্রামে কবরস্থান ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স ও হাফিজিয়া মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হাফেজ নাদের শেখ হেফজ বিভাগের ১১ বৎসর বয়সী ছাত্রকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে জোর করে বলাৎকার করে। এ সময় শিশুটির চিৎকারে অন্যরা উদ্ধার করে বলাৎকারী শিক্ষককে পুলিশে সোপর্দ করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়।

প্রিয় পাঠক এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে, দায়িত্ব নিয়ে স্বীকার করছি, নানা কারণে যার সবটাই প্রকাশ পায়না। পাঠক মাত্রই জানেন আমাদের কাগজ মুকসুদপুর সংবাদ মুকসুদপুর সীমায় আবদ্ধ, এলাকার বাইরের সংবাদ প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট না হলে প্রকাশ হয় না। তবুও পত্রিকার সংখ্যাগুলোতে খুন-ধর্ষণ, সহিংসতা, মাদকাসক্তি, চুরি-ছিনতাই, নিপীড়ন-নির্যাতন নানান রকমের অপরাধমূলক ঘটনার সংবাদে পত্রিকার পাতা জর্জরিত থাকে। যা সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক, নৈতিক, ব্যক্তি-চারিত্র্যিক অবক্ষয়ের চিত্র। তবে আমরা এক্ষণে কথা বলছি শিশু ধর্ষণ, বলাৎকার নিয়ে। কেননা এরকম বিদারক, উদ্বেগজনক ঘটনায় কোনরকম প্রতিবাদে সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশে কেউ এগিয়ে আসেন না। শুধুমাত্র বাঁশবাড়ীয়ার ঘটনায় মুকসুদপুর কলেজে বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দল বাসদ এর সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের আয়োজনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে। তাদেরকে সাধুবাদ জানিয়ে অন্যদের প্রতি আহ্বান করি শিশু ধর্ষণ, বলাৎকার, শিশু হত্যার মতো ঘটনার প্রতিবাদে আপনারা সরব হোন। আপনার প্রতিবাদী ভূমিকা এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ ও শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নির্মাণ ও সভ্যতার অগ্রযাত্রা প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্নিত করবে। মনে রাখতে হবে আমাদের পূর্বসূরিরা লড়াই সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে আমাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করেছেন, আমরা উত্তরসূরিদের জন্য দায় এড়াতে পারি না।

শিশু ধর্ষণ, শিশু বলাৎকার, শিশু হত্যা পাশবিক, পৈশাচিক, পশুত্বের দুষ্কর্ম, কোন বিবেকবান মানুষ এটা করতে পারে না। এটি ব্যক্তি, সমাজের রুচি সংস্কৃতির প্রশ্ন। কিন্তু সমাজে এটা অহরহ ঘটছে। সাধারণ সমাজে শিশু ধর্ষণ হত্যা হলেও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-এতিমখানায় শিশু বলাৎকারের ঘটনা বেশি ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঘটে থাকলেও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা-পরিচালনকারী কর্তৃপক্ষ ঘটনা রোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। অন্তত শিক্ষকদের পরিবারসহ আবাসিক ব্যবস্থা হলে কিছু মাত্রায় হলেও বলাৎকার রোধ করা সম্ভব হতো। কার্যত কওমী মাদ্রাসা, হেফজখানা, এতিমখানা শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ও সার্বক্ষণিক উপস্থিতি অনেকটাই বাধ্যতামূলক। ফলে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এখানে যৌন নিপীড়নের সুযোগ অত্যধিক। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার-শিক্ষা বিভাগের অনুমতি-অনুমোদন, নিয়ন্ত্রণ কার্যত নেই। ধর্মীয় কারণে সামাজিকভাবে কেউ আপত্তি করেন না; যার ফলে অবাধে যত্রতত্র গড়ে উঠছে। ধর্ম শিক্ষা অবশ্যই ভাল কথা, কিন্তু এসব উপদ্রব ঠেকাবে কে? আশ্চর্যের বিষয় কোন মাদ্রাসা তো দূরের কথা, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতিবাদ প্রতিরোধে টু শব্দটি করা হয় না।

অন্যদিকে দেখুন সম্প্রতি তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার, সমকামীতা নিয়ে দেশজুড়ে হৈচৈ হয়ে গেল। ঘটনার সূত্রপাত রাজধানী ঢাকায় আলোচিত জাতীয় শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে আলেম ওলামাদের উপস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিহাস ও সামাজিক বইয়ে হিজড়াদের জীবন নিয়ে রচিত সচেতনতামূলক পাঠ ‘শরীফার গল্প’ সমকামীতায় উৎসাহ দেয়ার অভিযোগে আলোচক ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন (বরখাস্তকৃত) শিক্ষক আসিফ মাহতাব শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পাতা দুটি ছিড়ে ফেলেন ও অন্যদেরকে ছিড়তে নির্দেশ দেন, এবং অধ্যাপক ড.সারোয়ার হোসেনসহ অন্য আলোচকরা অনুরূপ বক্তব্য রাখেন। এই ঘটনাটি যতটা না শিক্ষা সংস্কার সংশ্লিষ্ট ততোধিক রাজনৈতিক। কেননা আসিফ মাহতাব নিরেট মূর্খ নয়, যুক্তরাজ্যে ডিগ্রীধারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার মতো শিক্ষিত জনেরা কীভাবে ট্রান্সজেন্ডার অনুসঙ্গটিকে সমকামী আখ্যা দিয়ে শিশু শিক্ষামূলক পাঠ ছিড়ে ফেলে কেন প্রতিবাদী ঔদ্বত্য প্রকাশের মাধ্যমে সরকার বিরোধী ঘৃণা প্রদর্শন করেছেন, সেটি এক রহস্যঘেরা বিরাট প্রশ্ন হতে পারে। কেননা আসিফ মাহতাবরা মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের সমকামী ঘটনা এবং শিশু ধর্ষণের ঘটনা সমূহ দেখেন না, দেখলেও চুপ মেরে যান। প্রতিবাদ তো দূরের কথা মুখে কলুপ এঁটে লুকিয়ে থাকেন। উপরন্তু জীব-রসায়নের ক্ষেত্রে সেক্স-হরমোন এর বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল জৈবিক ভূমিকায় লিঙ্গ বৈচিত্র (জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার, এলজিবিটি, ইত্যাদি), জেন্ডার আইডেনটিটি, ইত্যাকার প্রসঙ্গ পশ্চিমে ও আমাদের সমাজে পরিভাষা ও ব্যবহারিক পার্থক্যে ভিন্নতা রয়েছে। তা সত্তেও বিষয়গুলি অনুপুঙ্খ অনুধাবনে আসিফ মাহতাবরা গুলিয়ে ফেলছেন যা অজ্ঞতার তুলনায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই অনুমান করা যায়।

বাঙলা বাঙালির সমাজ সভ্যতা নির্মাণে হাজার বৎসরের লড়াই সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গণমানুষের উৎসর্গিত ভূমিকার ধারাবাহিকতায় মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থপতি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরে মুক্তির লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কর্মধারা ছিল স্বতন্ত্র, ঐতিহ্যিক ও ব্যতিক্রমী। তিনি শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি; কায়েমী স্বাধীনতাবিরোধীরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় খোলনলচে পরিবর্তনে সর্ববিস্তার করে যা এখন পর্যন্ত নানা ছলে কলে-কৌশলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান আছে। জাতিরজনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে দীর্ঘ একুশ বৎসর পরে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কয়েক মেয়াদের সরকার পরিচালনায় দেশের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছেন। আমরা চাই বাঙালির সমাজ সভ্যতা রক্ষায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সূত্রে যাবতীয় জঞ্জাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আধুনিক-প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে সর্বাতœক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। কেননা দৈনন্দিন দৃশ্যমান অবকাঠামো-উপরিকাঠামো উন্নয়নের তুলনায় অন্তঃস্থ সমাজ নির্মাণের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা চাই সাংস্কৃতিক জাগরণে সরকার ও সকল সচেতন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দায়িত্বশীল অগ্রণী ভূমিকায় অবিলম্বে উদ্যোগী হবেন।-নির্বাহী সম্পাদক।